মুমিনের বৈশিষ্ট
আউযুবিল্লাহি
মিনাশশায়ত্বয়ানির রাজীম,
বিসমিল্লাহীর রহমানির রাহীম । মহান আল্লাহ পাক, পবিত্র কোরআন শরীফে বলেছেন,
লা ইন্ শাকারতুম্, লা আজিদান্নাকুম্, ওয়ালা ইন্ কাফারতুম্, ইন্না আজাবি লা শাদিদ ।
আল্লাহ বলেন, “যে
ব্যাক্তি আমার নিয়ামত পাইয়া নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করবে আমি তার নিয়ামত বহুগুণে বাড়াইয়া দেব, আর যে ব্যাক্তি আমার নিয়ামত পাইয়া নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করবে না আমি তার নিয়ামত ছিনাইয়া নিয়া কঠিন আযাবে গ্রেফতার করব” ।
আমাদেরকে বেশি বেশি আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া
আদায় করতে হবে । কারণ হাশরের ময়দানে নেয়ামতের কথা জিজ্ঞাসা
করা হবে । এটা আমার কথা না । স্বয়ং আল্লাহ তাআলা সূরা তাকাছুরে বলেছেন,
ছুম্মা লাতুস্য়ালুন্ না ইয়াওমা ইজিন্ আনিন
নাঈ-ম ।
অর্থাৎ, “এরপর
অবশ্যই সেদিন তোমরা নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে, সুখ-সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে” ।
আলো, বাতাস, পানি, আমাদের শরীর, ধন-সম্পদ সবই কি,
আল্লাহর নেয়ামত । এগুলোর হিসাব দেওয়ার ক্ষমতা কি আমাদের
আছে, নেই । তাই কি করতে হবে, আল্লাহর শুকরিয়া আদায়
করতে হবে । আমরা তো শুকরিয়া আদায় করতে রাজি আছি নাকি, ইনশাআল্লাহ । আউযুবিল্লাহি মিনাশশায়ত্বয়ানির রাজীম, বিসমিল্লাহীর
রহমানির রাহীম,
“আলিফ লা--ম্ মী--ম্
। যা-লিকাল কিতা-বু লারইবা ফি-হি হুদাল্লিল মুত্তাক্বী-ন । আল্লাযি-না ইউ’মিনু-না বিল গ্বইবি,
ওয়া ইউক্বিমু-নাস্ সালা-তা
ওয়া মিম্মা- রযাক্বনা-হুম ইউনফিক্বু-ন । ওয়াল্লাযি-না ইউ’মিনু-না বিমা--- উনযিলা ইলাইকা,
ওয়ামা--- উনযিলা মীন্ ক্বাবলিক । ওয়া বিল আ-খিরতিহুম ইউক্বিনু-ন । উলা----ইকা আলা- হুদাম্মির রব্বীহিম, ওয়া উলা----ইকা হুমুল মুফলিহু-ন
।
এই যে, পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে আমি কয়েককটি আয়াত পাঠ করলাম, সেই কোরআন শরীফ আমাদের কে দিয়েছেন, মহান আল্লাহ । আচ্ছা এখন যদি আপনাদের জিজ্ঞেস করা হয় যে, এই কোরআন শরীফে কয়টি সূরা আছে? অনেকেই জানি, অনেকেই জানি
না । হুজুররা বলেছেন, বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে শুনে আমরা জেনেছি যে কোরআন শরীফে ১১৪টি সূরা আছে, তাই আমরা
বলতেছি ১১৪টি । কিন্তু, আমরা নিজেরা কি কখোনো পড়ে দেখেছি যে হুজুররা ঠিকই বলেছেন নাকি তারা ভুল বলেছেন । আমরা পড়িনি । প্রথম সূরার নাম কি, শেষের সূরার নাম কি, কোন সূরার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা কি জানিয়েছেন, এসব কিছু আমরা অনেকেই জানিনা । আমাদের এসব জানা দরকার কি না? অবশ্যই দরকার । মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ১১৪টি সূরাই নাযিল করেছেন । এই ১১৪টি সূরার মধ্যে তিনটি সূরা আছে যার একটি হলো সূরা আল-মু’মিনুন, আরেকটি সূরা-মুনাফিকূন এবং আরেকটি সূরা-কাফিরুন । এই সূরাগুলোর মধ্যে আল্লাহ তাআলা মুমিন, মুনাফেক এবং কাফের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন । আচ্ছা, আমরা এখানে যারা উপস্থিত সবাইতো মুমিন তাই না
। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআন শরীফে
এই মুমিনদের কিছু বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন । বৈশিষ্ট মানে হচ্ছে গুণাবলী ।
আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের কিছু বৈশিষ্টের কথা বলে দিয়েছেন, যার মাধ্যমে আমরা সহজেই একজন মুমিনকে চিনতে পারি । আর এই বৈশিষ্টের কোন একটি বাদ গেলে তাকে কি বলা যাবে, না, পরিপূর্ণ মুমিন বলা যাবে না । আসুন এবার জেনে নেই আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের কি কি বৈশিষ্টের কথা বলেছেন । আউযুবিল্লাহি
মিনাশশায়ত্বয়ানির রাজীম, বিসমিল্লাহীর
রহমানির রাহীম,
আলিফ লা--ম মী--ম ।
“আলিফ লাম মীম” । কোরআনের পরিভাষায়
এগুলোকে বলা হয়
‘হরফে মুকাত্তাআত’ । কোন
কোন তফসীরকার এ
হরফগুলোকে ঐ সূরার
নাম বলেছেন, আবার
কেউ কেউ বলেন,
এগুলো আল্লাহর নামের
তত্ত্ব বিশেষ । অধিকাংশ
সাহাবী, তাবেয়ী এবং
ওলামার মধ্যে সর্বাধিক
প্রচলিত মত এই
যে,
‘হরফে মুকাত্তাআত’ গুলো
এমনি রহস্যপূর্ণ যার
মর্ম ও মাহাত্ম্য
একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই ভালো
জানেন । অন্য কাউকে
এ বিষয়ে জ্ঞান
দান করা হয়নি
।
এগুলো তেলওয়াত করতে
হবে,
কিন্তু এগুলোর রহস্য
উদ্ধারের ব্যপারে আমাদের
ব্যস্ত হওয়া উচিত
হবে না ।
যা-লিকাল কিতা-বু
লারইবা ফি-হ্ ।
“এটা ঐ গ্রন্থ
বা কিতাব যাতে কোনরুপ সন্দেহের অবকাশ নেই” ।
মহান আল্লাহ তা’আলা নিজে গ্যারান্টি দিয়ে বলতেছেন, এটি এমন এক কিতাব যাতে সন্দেহ তো দূরের কথা, সন্দেহ-সংশয়ের কোন অবকাশই নেই । এর পরেই তিনি বলেছেন,
হুদাল্লিল মুত্তাক্বী-ন ।
অর্থাৎ “পরহেযগারদের জন্য হিদায়াত বা পথ প্রদর্শনকারী” ।
যারা আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করে, তাদের জন্য এই কিতাব হেদায়েতস্বরুপ । আর যে ব্যক্তি হেদায়েত লাভে ইচ্ছুক সে যেন এ কিতাব বুঝে পড়ে, অনুধাবন করে এবং সে অনুযায়ী আমল করে । এর পরের আয়াতে মুমিনদের গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে ।
আল্লাযি-না ইউ’মিনু-না বিল গ্বইবি, ওয়া ইউক্বিমু-নাস্
সালা-তা ওয়া মিম্মা- রযাক্বনা-হুম ইউনফিক্বু-ন ।
আল্লাযি-না ইউ’মিনু-না বিল গ্বইব ।
অর্থাৎ, “যারা
আল্লাহকে ভয় করে, তারা এমন লোক যে, অদৃশ্যে বিশ্বাস করে” ।
ইউ’মিনু-না মানে হচ্ছে ঈমান । ঈমান শব্দের অর্থ হচ্ছে, কারো কথাকে তার বিশ্বস্ততার নিরিখে মনে-প্রাণে
মেনে নেয়া, বিশ্বাস করা । মনে করেন, কোন লোক যদি এক টুকরা
সাদা কাপড়কে সাদা এবং এক টুকরা কালো কাপড়কে কালো বলে এবং আরেক ব্যক্তি তার কথা সত্য
বলে মেনে নেয়, তাহলে একে ঈমান বলা যাবে না । অন্যদিকে, রাসূল (সাঃ)-এর কোন কথা কেবলমাত্র রাসূল (সাঃ)-এর উপর বিশ্বাসবশত মেনে নেয়াকেই শরীআতের পরিভাষায়
ঈমান বলে । কেননা এক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ)-এর কথা বিশ্বাস করার আগে আমাদের বিশ্বাস
করতে হবে যে, তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল (সাঃ) । গ্বইব মানে হচ্ছে অদৃশ্য, অর্থাৎ এমন
সব বিষয়বস্তু যা মানুষের জ্ঞানের বাইরে এবং যা মানুষ চোখ দিয়ে দেখতে পারে না,
কান দিয়ে শুনতে পারে না, নাক দিয়ে ঘ্রাণ নিতে পারে
না, জিহ্বা দ্বারা স্বাদ নিতে পারে না এবং হাত দ্বারা স্পর্শ
করতে পারে না । এখন ঈমান বিল গাইব বা অদৃশ্যে বিশ্বাসের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, রাসূল (সাঃ) যে হেদায়েত
এবং শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন সে সবগুলোকে আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া ।
আল্লাহ আছেন এইটা তো সবাই মানি, নাকি । ইহুদী, খ্রীষ্টানরাও মানে যে
আল্লাহ আছেন । যেমন, ইহুদীরা বলে যে, উযাইর
ইবনুল্লাহ অর্থাৎ, উযাইর আল্লাহর ছেলে । নাউজুবিল্লাহ । আল্লাহর ছেলে মানে তারা এইটা বিশ্বাস করতেছে যে আল্লাহ আছেন । আবার খ্রীষ্টানরা বলে যে, ঈসা
ইবনুল্লাহ অর্থাৎ, ঈসা আল্লাহর ছেলে । আল্লাহর ছেলে মানে তারাও এইটা বিশ্বাস করতেছে যে আল্লাহ আছেন
। সুতরাং আমি বিশ্বাস করলাম যে আল্লাহ আছেন
আর আমি ঈমানদার হয়ে গেলাম, না । সবই বিশ্বাস করলাম, তাহলে তো
ঈমানদার হয়েই গেলাম, তাই না । না, বলা হয় যে, শুধু জানার
নামই ঈমান নয়, কেননা অনেক কাফেরও জানতো যে, আল্লাহ আছেন, রাসূল (সাঃ)
আল্লাহর নবী, কিন্তু না মানার কারণে তারা কাফেরই
রয়ে গেছে । আমরা মনে করতে পারি যে, আল্লাহ এবং রাসূলকে বিশ্বাস করলাম তাহলেই তো ঈমানদার হয়ে গেলাম
। না, আল্লাহ
এবং রাসূল (সাঃ) এর প্রতি বিশ্বাস ততক্ষণ
পর্যন্ত গ্রহনযোগ্য হবে না অর্থাৎ গ্রহন করা হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত এই বিশ্বাস মুখে
স্বীকার করার সাথে সাথে কাজের দ্বারা প্রকাশ করা না হয় মানে, আমল না করা হয় । ঈমান ব্যতীত কোন সৎকর্মই আল্লাহ তাআলার কাছে সৎকর্ম নয় ।
আচ্ছা, বলেন তো, এই যে পৃথিবী,
আকাশ, বাতাস, এগুলো কে তৈরী
করেছেন । আল্লাহ । এই যে চন্দ্র, সূর্য,
এগুলো কে চালাচ্ছেন । আল্লাহ । আকাশ থেকে বৃষ্টি দেয় কে, বৃষ্টির পানি দিয়ে মরা ঘাসকে তাজা করে কে । আল্লাহ । আল্লাহ তাআলা সূরা আনকাবূতের ৬১ নম্বর আয়াতে রাসূল (সাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলতেছেন,
ওয়ালা ইন্- সা আলতাহুম্- মান খলাক্বাস্ সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদা ওয়া সাখ্খরশ্ শামসা ওয়াল ক্বামার লাইয়াক্বু-লুন্ নাল্লাহ ।
অর্থাৎ, রাসূল
(সাঃ) কে বলা হচ্ছে যে, “যদি আপনি তাদেরকে মানে কাফেরদেরকে জিজ্ঞেস করেন, কে আকাশমণ্ডলী
ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, এবং চন্দ্র-সূর্য
কে নিয়ন্ত্রণ করছেন । তবে তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ” ।
আবার, আল্লাহ তাআলা সূরা আনকাবূতের ৬৩ নম্বর আয়াতে
রাসূল (সাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলতেছেন,
ওয়ালা ইন্- সা আলতাহুম মান্- নায্যালা মিনাস্ সামা----ই মা----আন ফাআহ্ইয়া- বিহিল আরদা মীম্-
বাঅদি মাউতিহা- লাইয়াক্বু-লুন্ নাল্লাহ ।
অর্থাৎ, রাসূল
(সাঃ) কে বলা হচ্ছে যে, “যদি আপনি তাদেরকে মানে কাফেরদেরকে জিজ্ঞেস করেন, আকাশ
থেকে কে পানি বর্ষণ করে অতঃপর তা দিয়ে মাটিকে উহার মৃত হওয়ার পর জীবিত করে,
তবে তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ” ।
এই দুটি আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কাফেররাও বিশ্বাস করে
সবই আল্লাহ করতেছেন । তাহলে আমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করলেই ইমুমিন
হয়ে যাব তা না । একটা বৈশিষ্ট অর্জন করলাম মাত্র । কারণ আল্লাহ তাআলা ঈমান আনার পরেই মুমিনদের
আরেকটি বৈশিষ্টের কথা বলতেছেন । তা হলো,
ওয়া ইউক্বিমু-নাস্ সালা-তা
।
অর্থাৎ, “নামায
প্রতিষ্ঠা করে” ।
কারা নামায প্রতিষ্ঠা করবে, যারা মুমিন । নামায প্রতিষ্ঠা করা এই নয় যে, নামায পড়লাম হয়ে গেল । কথাটি বুঝার জন্য আমরা একটা উদাহরণ ব্যবহার
করতে পারি । যেমন, কেউ একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করবে । এখন সে যদি শুধু একটা বড় বিল্ডিং তৈরী
করে বসে থাকে তাহলে সেটা কি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হলো । হলো না । সেখানে শিক্ষকের ব্যবস্থা করতে হবে, ছাত্র-ছাত্রীর ব্যবস্থা করতে হবে, পড়াশুনা ঠিকমত চালাতে হবে
এবং এতকিছু ঠিকঠাক মতো হলে তারপর আমরা বলতে পারি স্কুলটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । ঠিক তেমনি নিজে নামায পড়তে হবে, পরিবারের সবাইকে পড়তে
বলতে হবে, আশে-পাশের মানুষদের বলতে হবে,
তারপর সেটা হবে নামায প্রতিষ্ঠা করা । প্রতিষ্ঠা অর্থ শুধু নামায আদায় নয়, নামাযকে সকল দিক দিয়ে
ঠিক করাকে প্রতিষ্ঠা করা বলা হয় । নামাযে সকল ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত এবং মুস্তাহাব সঠিক ভাবে আদায় করা । আমরা তো নামাযের মধ্যেই সব ক্ষেত খোলা
থেকে, দোকান-পাট থেকে, বাজার থেকে এমনকি সারা পৃথিবী ঘুরে আসি । পড়তাছি নামায অথচ মন ঘুরতাছে ক্ষেতের বাতর
দিয়া, পড়তাছি নামায
অথচ মন ঘুরতাছে মাছের দোকানের সামনে দিয়ে । আর এই নামায আমাকে জান্নাতে নিতে পারবে
। পারবে না ।
আমার নিজের আমল দিয়ে অর্থাৎ নিজের নামায, রোজা দিয়ে জান্নাতে যাওয়া
খুব কঠিন হয়ে যাবে । কেননা, আমার নামায, রোজা সঠিক
ভাবে আদায় হচ্ছে কিনা কে জানে । এই অবস্থায় আমি যদি অন্য একজনকে নামাযের
দাওয়াত দেই, আর সে যদি
নামায পড়ে তাহলে আমাকে কবুল নামাযের সওয়াব আল্লাহ তাআলা দিবেন । আমার নামায কবুল হয় কি না জানি না, যাকে নামাযের কথা বললাম
তার নামায কবুল হোক বা না হোক আমি কবুল নামাযের সওয়াব পাবই, ইনশাআল্লাহ
। তাহলে মুমিনের প্রথম বৈশিষ্ট হলো, আল্লাহর উপর ঈমান আনা
এবং দ্বিতীয় বৈশিষ্ট হলো, নামায প্রতিষ্ঠা করা । তিন নম্বর বৈশিষ্টে আল্লাহ তাআলা কি বলতেছেন,
ওয়া মিম্মা- রযাক্বনা-হুম
ইউনফিক্বু-ন ।
“আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা থেকে ব্যয়
করে” ।
আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন বলতেছেন,
মুমিনেদর আমি যে ধন-সম্পদ দিয়েছি সেই ধন-সম্পদ থেকে তারা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে । যেমন, ফরজ যাকাত, ওয়াজিব সদকা
এবং নফল দান-খয়রাত সবই আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা বুঝানো হয় । একজন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষ চিন্তা
করবে যে, আমার নিকট
যা কিছু আছে, তা সবই তো আল্লাহর দান এবং আমানত । যদি আমি সমস্ত ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে খরচ
করি তবে তা মাত্র নেয়ামতের হক আদায় হবে । এটা এমন নয় যে, আমি অমুককে দান করলাম
আর তার প্রতি দয়া করলাম । যে ধন-সম্পদ আমাদেরকে দেয়া হয়েছে তার সবই দান করতে
হবে এমন নয়, বরং কিছু অংশ দান করার কথা বলা হয়েছে । কিন্তু আফসোস, আমরা ধন-সম্পদকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে থাকি মনে হয় এগুলো নিয়ে আমরা কবরে যেতে পারব । টাকা পয়সা কামাইয়ের চিন্তায় আমরা আল্লাহর
কথা, কবরের কথা
ভুলে যাই । আর এটাই আল্লাহ তাআলা সূরা তাকাসুরে বলতেছেন,
আলহা-কু মুত্তাকা-ছুর । হাত্তা-যুর তুমুল মাক্ব-বির । কাল্লা- সাওফা তাআলামু-ন ।
অর্থ হচ্ছে, “অর্থের লালসা তোমাদেরকে গাফেল রাখে । এমনকি তোমরা কবর স্থানে
পৌছে যাও । এটা কখনো উচিত নয় । তোমরা তাড়াতাড়িই জেনে নেবে
।
আয়াতের মর্মার্থ এই যে, ধন-সম্পদের প্রাচুর্য তথা ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ও বংশ-গোত্রের বড়াই
আমাদেরকে গাফেল ও উদাসীন করে রাখে, নিজেদের পরিণতি এবং হিসাব
নিকাশের কোন চিন্তাই আমরা করি না । এমনি অবস্থায় আমাদের মৃত্যু এসে যায় এবং
মৃত্যুর পর আমরা আযাবে গ্রেফতার হই । আমরা যদি কেয়ামতের হিসাব-নিকাশের কথা নিশ্চিত বিশ্বাস
করতাম তাহলে আমরা কি করতাম না, কখনো অর্থের বড়াই করতাম না । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে শিখখীর (রাঃ) বলেন, আমি একদিন রাসূল (সাঃ)
এর নিকট গিয়ে দেখলাম তিনি সূরা তাকাছুর তেলওয়াত করে বলতেছিলেন,
“মানুষ বলে, আমার সম্পদ,
আমার সম্পদ, অথচ তোমার সম্পদ তো ততটুকুই,
যতটুকু তুমি খেয়ে শেষ করে ফেল অথবা পরিধান করে ছিড়ে ফেল অথবা সদকা করে
সম্মুখে পাঠিয়ে দাও । এছাড়া যা আছে, তা তোমার হাত থেকে চলে যাবে, তুমি অপরের জন্য তা ছেড়ে যাবে” ।
এই যে আমি বলতেছি, এটা আমার, ঐটা আমার আসলে
এর মধ্যে যেটুকু আমি খেয়ে শেষ করতেছি, যে কাপড় পড়ে ছিড়ে ফেলছি
এবং যা আমি ছদকা করতেছি শুধু সেটুকুই আমার । বাকি সব আমার হাত থেকে চলে যাবে, অন্যের জন্য রেখে আমাকে মরতে হবে । হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেন,
“আদম সন্তানের যদি স্বর্ণে পরিপূর্ণ উপত্যকা থাকে,
তবে সে (তাতেই খুশি হবে না, বরং) দুটি উপত্যকা কামনা করবে । তার মুখ তো (কবরের) মাটি ছাড়া অন্য
কিছু দিয়ে ভর্তি করা সম্ভব না । যে আল্লাহর দিকে রুজু করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন” ।
উপত্যকা মানে দুইটা পর্বতের মাঝখানে যে গর্তের মত যায়গা থাকে । মানুষ কি করবে একটা স্বর্ণের উপত্যকা পেলে আরো একটা আশা করবে
। তার লোভ কখনো শেষ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত
কবরের মাটি দিয়ে তার মুখ ভর্তি না হবে অর্থাৎ সে মারা না যাওয়া পর্যন্ত লোভ করবেই ।
তাহলে মুমিনের তিন নম্বর বৈশিষ্ট হলো, আল্লাহর
রাস্তায় খরচ করা । এরপর আল্লাহ তাআলা বলতেছেন,
ওয়াল্লাযি-না ইউ’মিনু-না বিমা--- উনযিলা ইলাইকা, ওয়ামা---
উনযিলা মীন্ ক্বাবলিক । ওয়া বিল আ-খিরতিহুম ইউক্বিনু-ন ।
বলা হচ্ছে, “এবং যারা
বিশ্বাস স্থাপন করে যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি
অবতীর্ণ হয়েছে । আর পরকালকে যারা নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করে” ।
এর মানে হচ্ছে, মুমিনরা কি করবে, হযরত
মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর যে কোরআন নাযিল হয়েছে
এবং আগের রাসূলদের উপর যে অন্যান্য আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছে তা বিশ্বাস করবে । আর তারা পরকালকে বিশ্বাস করবে । এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আখিরাতকে
বিশ্বাস করলে আমার আমল করার উৎসাহ জাগবে । যেমন, কেউ যদি বিশ্বাস না করে
যে, তাকে মরার পর আবার জীবিত করা হবে, আল্লাহর
সামনে দাঁড়াতে হবে, তাঁর কাছে হিসাব দিতে হবে এবং পাপ করলে অনন্তকাল
জাহান্নামের শাস্তি দেওয়া হবে, তাহলে সে তখন যেকোনো খারাপ কাজ
করতে ভয় পাবে না । অন্যদিকে কেউ যদি বিশ্বাস করে যে, আমাকে মৃত্যুর
পর আবার জীবিত করা হবে, আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে,
পাপ করলে অনন্তকাল জাহান্নামের শাস্তি পেতে হবে, তাহলে সে কখনোই খারাপ কাজ করতে সাহস পাবে না । কারণ সে চিন্তা করবে, পাপ কাজ
আমি প্রকাশ্যেই করি আর গোপনেই করি, রাজপথেই করি বা কোন বন্ধ ঘরের
ভিতরেই করি, মুখে আর ভাব-ভঙ্গিতে প্রকাশ
করি বা নাই করি, আমার সকল কাজকর্ম, এমনকি
অন্তরে লুকায়িত সবকিছু সর্বত্র বিরাজমান আল্লাহ তাআলা জানেন । তাঁর দৃষ্টির সামনে কোন কিছু আড়াল করার সাধ্য আমার নেই, তিনি সব দেখেন এবং জানেন ।
আচ্ছা এই যে, আমরা দুনিয়া দুনিয়া বলে চিৎকার করতেছি,
সম্পদ সম্পদ বলে চিল্লাচ্ছি, এগুলো তো আমাদের ভাগ্যের
ব্যপার । আমাকে সৃষ্টি করার আগে আল্লাহ পাক আমার
ভাগ্য লিখে রেখেছেন । আমরা কালেমা শাহাদাৎ বলার সময় বলি যে,
ওয়াল ক্বদরী খইরিহী- ওয়া শাররিহী মিনাল্লাহি তাআলা ।
এখানে আমরা আমাদের তকদীর মানে ভাগ্য যে
একমাত্র আল্লাহর হাতে তা আমরা বিশ্বাস করি, মেনে নেই । আসলে দুনিয়া হচ্ছে ভাগ্যের সাথে সম্পর্কিত
। কেমনে ভাগ্যের সাথে সম্পর্কিত আমি বলতেছি, মনে করেন একলোক অনেক পরিশ্রম
করে কোটিপতি হলো, এখন তার ঘরে একটি সন্তান জন্ম নিলো । তাহলে সেই সন্তানটিও কোটিপতি হয়ে গেল । কিন্তু পরকালের সাথে আমাদের আমল সম্পর্কিত
। ঐ সন্তানটি এমনিতেই কোটিপতি হলেও আমল না
করে কেউ পরকালে পার হতে পারবে না । কোন পীর বা আলেমের ছেলেও আমল না করে জাহান্নাম
থেকে মুক্তি পাবে না । হযরত নূহ (আঃ) এর ছেলে যেমন ঈমান না আনার কারণে পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল, জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে । আমরা যদি আখেরাতে ভাল চাই তার জন্য আমল
করতে হবে । তাহলে একজন মুমিন বান্দার বৈশিষ্ট হলো,
- ঈমান আনবে ।
- নামায প্রতিষ্ঠা করবে ।
- আল্লাহর রাস্তায় খরচ করবে ।
- আল্লাহর কিতাবে বিশ্বাস করবে ।
- নবী রাসূলদের বিশ্বাস করবে ।
- আখেরাতে বিশ্বাস করবে ।
কারো মধ্যে যদি এই গুণগুলো থাকে তবে তাকে
মুমিন বলা যাবে । আর যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানল এবং সে অনুযায়ী
আমল করল তার জন্য রয়েছে অফুরন্ত সুখ-শান্তির জান্নাত । মুমিন বান্দারা সফলকাম । আল্লাহ বলেন,
উলা----ইকা আলা- হুদাম্মির রব্বীহিম, ওয়া উলা----ইকা হুমুল মুফলিহু-ন ।
অর্থাৎ, “তারাই
নিজেদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সুপথ প্রাপ্ত, আর তারাই যর্থার্থ
সফলকাম” ।
মুমিনরাই সরল-সঠিক পথের পথিক,
যা তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে দান করা হয়েছে । আর মুমিনরাই সম্পূর্ণ সফলকাম হয়েছে ।