সাভারে ধসে পড়া ভবন থেকে একের পর এক লাশ এবং আহত ব্যক্তিদের বের আনা এবং সেই সাথে হারানো স্বজনদের খোঁজে দিশেহারা মানুষের আর্তচিৎকারে চোখের টানি ধরে রাখা খুবই কষ্টকর । উদ্ধার হওয়া আহত ব্যক্তিদের হৃদয় বিদারক বর্ণনা শুনলে শরীর ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যায় । অন্যদিকে স্বজনদের জীবিত বা মৃত পাওয়ার আশায় যারা এখনো তাদের আপনজনদের ফটো হাতে হাসপাতালে, ভবন ধসের জায়গায় কিংবা অধরচন্দ্র মাঠে যেখানে লাশ রাখা হয়েছে সেখানে ছুটোছুটি করছেন তাদের আহাজারিতে চোখের কোণা ভিজে যায় অনায়াসে ।
ধসে ভবনের সপ্তম তলা থেকে উদ্ধার হওয়া মেঘলা আক্তারের মর্মস্পর্শী বর্ণনা, 'বিল্ডিং ভাইঙ্গা পড়ার লগে লগে আমি দৌড় দেই। ফ্লোরটা লিফটের মতো
নিচে নামতে নামতে ঘটাং কইরা থামে । আর দড়াম কইরা ছাদ ভাইঙ্গা আইসা ঠেকল
মাথার একটু উপরেই । আমার আশেপাশে আরও কয়েকজন ছিল । তারা কানছিল, চিক্কুর
পারতেছিল । তয় চাইরদিক অন্ধকার বইলা কাউরে দেহা যাইতেছিল না । একজন মোবাইলের
লাইট জ্বালাইল । দেখলাম, আমার পাশে পইড়া আছে একটা মাইয়ার লাশ । হেরপর আমিও
কান্নাকাটি শুরু করি ।'
আকের নারী কর্মী আকলিমা, তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও বাঁচতে পারেনি তার বোন ফজিয়া । বোনের লাশ শনাক্ত করে লাশের পাশে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন । তিনি বলেন, 'সাততলায় আমরা দুই বোন একই সঙ্গে কাজ করছিলাম । নয়টার দিকে বিকট শব্দ হওয়ার পরপরই আমরা দৌড় দিই । এ সময় একপাশের দেয়াল আমাদের দিকে ভেঙ্গে পড়লে আমার বোন আমাকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দেয় । আর বোন (ফজিয়া) দেয়াল চাপা পড়ে । আমাকে বাঁচাতে গিয়ে ও মরে গেছে । বোন আমাকে বাঁচালো, কিন্তু আমি ওকে বাঁচাতে পারলাম না ।'
উদ্ধার হওয়া রত্না বলেন মর্মস্পর্শী আর শিউরে উঠার মতো এক কাহিনী । হাসপাতালে তিনি বলেন, 'মাথার উপরেই ছাদ । কান্দে আর হাতে গরম পাইপ লাইগা রইছে । পুইড়া যাইতেছিলাম ।
তয় নড়বার পারতেছিলাম না । অন্ধকার । ছোড ছোড নিঃশ্বাস নিছি । চোখ বুইজা
খালি কানছি । হঠাৎ খটখট আওয়াজ আসে । কেউ আছেন? কেউ আছেন? বইলা কারা জানি চিৎকার
করতেছিল । আমিও 'বাঁচান' 'বাঁচান' বলে চিল্লান দেই । পরে কয়েকটা ছেলে
দেওয়াল কাইট্যা আমারে হাসপাতালে নিয়া আসে ।'
সাহসী নারী নূপুর তাঁর অভিজ্ঞতা শোনালেন এভাবে: 'এক হাতেরও কম জায়গায় আইটকা
ছিলাম । মাথা দিয়া রক্ত পড়তেছিল । আমার ডান হাতের ওপর একটা লাশ । আর লাশটার
উপরে দেওয়াল । হাত বাইর করতে পারতেছিলাম না । ছোট একটা ফাঁক দিয়া দেখি,
অনেকেই হাঁটতেছে । বাম হাত একটু বাইর কইরা আমি চিৎকার দিয়া কইলাম, ভাই কিছু
একটা দেন, ডাইন হাতটা কাটি ।' নূপুর জানান, তাঁকে বাইরে থেকে একটা ছোট বঁটি দেওয়া হয় । কিন্তু তা দিয়ে
হাত কাটতে পারেননি । অনেকক্ষণ পরে দেওয়াল তুলে কয়েকজন তরুণ তাঁকে উদ্ধার
করেন ।
'মা রে, তুমি কেন ঢাকায় চাকরি করতে গেলা । এখন আমি ও ছোট বোন কাকে মা বলে
ডাকব ।' মা আরজিনা বেগমকে (২৭) হারিয়ে আলপনা আক্তারের গগনবিদারী চিৎকার । আরজিনার স্বামী আলাউদ্দিন সাভারের একটি দরজির দোকানে কাজ করেন । আরজিনা তৈরি
পোশাক কারখানায় কাজ পান ছয় মাস আগে । অভাব-অনটনের কারণে তিনি সন্তান দুটি
রেখে যান মায়ের কাছে । আলাউদ্দিন বলেন, 'স্ত্রীর লাশ নিয়া যে বাড়ি ফিরব,
এইটা তো কোনো দিন ভাবি নাই । বাঁচি থাকার জন্যে ঢাকাত আসনো । সেই ঢাকাত
আসিয়া সর্বনাশ হইল ।'
এই মাসেই ছুটিতে বাড়ি আসার কথা ছিল তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক আবদুর
রাজ্জাকের (২২) । সপ্তাহ খানেক আগে বাবার হাতখরচের জন্য ৫০০ টাকাও
পাঠিয়েছিলেন । একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাবা আজিজুল ইসলাম বাকরুদ্ধ । লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে
পড়েন গ্রামের অনেকে । গতকাল দুপুরে জানাজা শেষে তাঁর লাশ পারিবারিক
কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে । রাজ্জাকের ছোট বোন শারমিন (৮) বলে, 'আমার জন্য
জামা আনতে চেয়েছিল। আমার ভাই আর বাঁচে নাই।'
ঘটনার পরপরই বোন পারভিন আক্তারকে মোবাইলে ফোন করেন ভাই শের আলী ।মোবাইলটা কোন রকমে রিসিভ হয় । ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে । কিছুক্ষণ পর সংযোগ কেটে যায় । বোনের মোবাইলে আর সংযোগ দিতে পারননি শের আলী । ঘটনার এক ঘন্টা আগেও কথা হয়েছে পঞ্চমতলায় কর্মরত বোন পারভিনে সাথে । শের আলী এসব বলতে বলতে বুকে চাপড় দিয়ে কাঁদতে থাকেন ।
'আব্বা,
আমাদের ফ্যাক্টরিতে গতকাল ফাটল দেখা দিছে । তাই কাজে যাতে ইচ্ছা করছে না ।
বিল্ডিং ভাঙে পড়লে তো মরি যাব । কিন্তু কাজে না গেলে তো চাকরি থাকবি না ।
আমার জন্য দোয়া কইরেন ।' নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বাগডোব গ্রামের আল্পনা
খাতুন (১৭) গত বুধবার সকাল সাতটায় মুঠোফোনে বাবা জালাল উদ্দিনের সঙ্গে
এভাবেই তার আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল । এর কিছু সময় পর সে সাভারের রানা প্লাজা
ধসে মারা যায় । তার মতো নাটোরের আরও দুই নারী শ্রমিক ওই দুর্ঘটনায় মারা
গেছেন ।